লজ্জা মুমীনের অলংকার – আরিফুল হক এনামী


লজ্জা মুমীনের অলংকার :


লজ্জা ও সম্ভ্রম মানুষের এমন একটি স্বভাবজাত গুণ; যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বহুবিদ নৈতিক গুণাবলীর সমাবেশ ঘটে। লজ্জাশীলতার কারণেই মানুষের মধ্যে স্বচ্ছতা ও নির্মলতার বিকাশ ঘটে। জবাবদিহিতার আগ্রহ তৈরি হয়। এমনকি লজ্জা বা সম্ভ্রমের কারণে যাবতীয় জটিলতা, কুটিলতা, পাপ-পংকিলতা ও মলিনতা থেকে মুক্ত থাকা যায়।

লজ্জাশীলতা যার মাঝে যতটুকু থাকে, প্রকাশ্যে কোনো অন্যায় করতে সে ততটাই সংকোচ বোধ করে। তাই হাদীসের মধ্যে এটাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন:
الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ.
“ঈমানের সত্তরোর্ধ শাখা রয়েছে। এর মাঝে সর্বোত্তম হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, আর সর্বনিম্নটি হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেয়া। আর লজ্জাশীলতাও ঈমানের একটি শাখা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস – ৩৫)

শুধুই ঈমানের শাখা নয় বরং এ লজ্জাশীলতাকে রাসূলুল্লাহ (সা:) দ্বীন ইসলামের মূল চরিত্র হিসেবেই অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন:
إِنَّ لِكُلِّ دِينٍ خُلُقًا، وَخُلُقُ الإِسْلاَمِ الْحَيَاءُ.
“প্রতিটি দীনেরই একটি চরিত্র রয়েছে। ইসলামের চরিত্র হলো লজ্জাশীলতা।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস – ৪১৮১)

লজ্জাশীলতার কারণে মানুষ মন্দ কাজ পরিহার করে। নবী (সা:) বলেন:
الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِي إِلاَّ بِخَيْرٍ
“লজ্জাশীলতা কেবলই কল্যাণ নিয়ে আসে।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস- ৬১১৭)

মানুষকে সৃষ্টির পর থেকে এই গুণকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই এক হাদীসে রাসুল (সা:) বলেন:
إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النُّبُوَّةِ الأُولَى إِذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ.
“নবুওতের সূচনাকাল থেকে যে বিষয়গুলো মানুষের মাঝে অবিচ্ছিন্নভাবে আছে সে সবের অন্যতম হলো, তুমি যখন নির্লজ্জ হয়ে পড়বে তখন যা ইচ্ছা তা-ই করো। 
(সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬১২০)

লজ্জা আল্লাহ তাআলার বিশেষ গুণ। হাদীস শরীফে বর্ণিত,
ان ربکم تبارک و تعالی حیی کریم یستحیی من عبده اذا رفع یدیه الیه ان یردهما صفرا
“তোমাদের প্রতিপালক লজ্জাশীল, পরম দয়ালু। বান্দা যখন তাঁর দরবারে উভয়হাত উঠায়, তখন তিনি বান্দার খালি হাত ফেরত দিতে লজ্জাবোধ করেন।’ 
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৮৮)

আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) নিজেও অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। এ সংক্রান্ত  হাদীসে অনেক বর্ণনা এসেছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 
کان النبی ﷺ أشد حیاء من العذراء فی خدرها
“রাসুল (ﷺ) গৃহবাসিনী পর্দানশিন কুমারীদের চেয়েও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। 
(সহীহ বুখারি, হাদিস : ৩৫৬২)

শুধু তা নয় বরং এই লজ্জাশীলতা সকল নবীদের সুন্নাত। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন,
أربع من سنن المرسلین : الحیاء و التعطر و السواک و النکاح
“চারটি জিনিস নবীদের সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।
১.লজ্জাশীলতা, 
২.সুগন্ধি ব্যবহার,
৩.মিসওয়াক, 
৪.বিয়ে।”
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৮০)

লজ্জা এবং ঈমান একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানের গুণ থাকবে তার মধ্যে অব্যশই লজ্জার মতো মূল্যবান গুণও থাকবে। যার মধ্যে লজ্জা থাকবে না তার মধ্যে ঈমানও থাকবে না পূর্ণাঙ্গ।

রাসূল (সা.) বলেছেন, লাজুকতা ও কম কথা বলা ঈমানের দুটি বৈশিষ্ট্য। আর অশ্লীলতা ও বাচালতা মুনাফিকির দুটি বৈশিষ্ট্য।

লজ্জা ইসলামের প্রকৃতি ও স্বভাব কেননা ইহা মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে।
রাসূল (সা.) বলেন:
لکل دین خلق و خلق الاسلام الحیاء
“প্রতিটি ধর্মের একটি বিশেষ স্বভাব আছে। আর ইসলাম ধর্মের বিশেষ স্বভাব হল লজ্জা।’ 
(মুয়াত্তা মালেক, খ-২, পৃ-৯০৫)

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
ما کان الفحش فی شيء قط الا شانه و لا کان الحیاء فی شیء قط الا زانه
“কোনো কিছুতে যদি অশ্লীলতা থাকে, তাহলে তা ইহাকে শুধু কলুষিত করে আর কোনো কিছুতে যদি লজ্জা থাকে, তা ইহাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।”
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১২৬৮৯)

লজ্জা বলতে আমরা সাধারণত মানুষে মানুষে পারস্পরিক লজ্জার কথাই বুঝি। কিন্তু নবী (সা:) লজ্জাশীলতার বর্ণনা কিভাবে দিলেন, তা আমরা নিচের হাদীস থেকে উপলদ্ধি করি।
একদা তিনি (সা:) সাহাবাদেরকে বললেন, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে যথাযথ লজ্জা অবলম্বন করো। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আলহামদু লিল্লাহ, আমরা লজ্জা অবলম্বন করি। নবী (ﷺ) তখন বললেন: 
لَيْسَ ذَاكَ ، وَلَكِنَّ الاِسْتِحْيَاءَ مِنَ اللهِ حَقَّ الحَيَاءِ أَنْ تَحْفَظَ الرَّأْسَ وَمَا وَعَى، وَالبَطْنَ وَمَا حَوَى، وَلْتَذْكُرِ الْمَوْتَ وَالبِلَى، وَمَنْ أَرَادَ الآخِرَةَ تَرَكَ زِينَةَ الدُّنْيَا، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ اسْتَحْيَا مِنَ اللهِ حَقَّ الحَيَاءِ.
“আমি তো এটা বলিনি। বরং আল্লাহর সঙ্গে যথাযথ লজ্জা হবে এমন- তুমি মাথা হেফাযত করবে, মাথা যা কিছু ধারণ করে তাও হেফাযত করবে, পেট হেফাযত করবে, পেট-সংলগ্ন যা কিছু আছে তাও হেফাযত করবে, আর মৃত্যুকে স্মরণ করবে, স্মরণ করবে (মৃত্যু পরবর্তী সময়ে) চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মাটিতে মিশে যাওয়াকেও। আর যে পরকাল কামনা করে সে তো দুনিয়ার জৌলুস বর্জন করে। এগুলো যে করতে পারল সে-ই আল্লাহর সঙ্গে যথাযথ লজ্জা অবলম্বন করল। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৫৮)

তাই আমাদের উচিত নিজেই লজ্জাশীল হওয়া ও সন্তানদেরও লজ্জাশীল করে গড়ে তোলা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দাও।


আরিফুল হক এনামী

প্রভাষক,
আধুনগর ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা
লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *